Thursday, 23 January, 2025
Logo

জবাবদিহিতা না থাকায় ১৫ বছরে অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে

অনলাইন ডেস্কঃ

প্রকাশিত: / বার পড়া হয়েছে


ছবি - সংগৃহীত

বিগত সরকারের সময়ে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী নানাভাবে সুবিধা আদায় ও নীতিমালা তৈরিতে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন দখল করেছে। ঋণখেলাপি, অর্থপাচার, ব্যাংক ব্যবস্থাসহ দেশের অর্থনীতির নানা দুর্বল দিক, কোনোটিই নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে। বিগত ১৬ বছরের জবাবদিহিতা না থাকায় সমস্যাগুলো অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। বিগত সরকারের অপশাসন ঋণখেলাপির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হিসেবে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিআইসিসির কার্নিভ্যাল হলে গতকাল শনিবার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি-২০২৪ আয়োজিত ‘শ্বেতপত্র এবং অতঃপর : অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক সিম্পোজিয়ামে বক্তারা এসব কথা বলেন।

ঋণখেলাপি, অর্থপাচার, ব্যাংক ব্যবস্থার দুরবস্থাসহ দেশের অর্থনীতির নানা দুর্বল দিকের কথা উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, এর কোনোটিই নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে। বিগত ১৬ বছরের জবাবদিহিতা না থাকায় সমস্যাগুলো অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। বিগত সরকারের অপশাসন ঋণখেলাপির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হিসেবে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। পুরো আর্থিক খাত রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালিত হয়েছে।

এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা স্বল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব নয় মন্তব্য করে রেহমান সোবহান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তবে তারা কিছু শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। ভবিষ্যৎ নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের ওপর গুরুদায়িত্ব পড়বে। তাদের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ও সি টিজেনস প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজিএস, বাংলাদেশের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত বাজেটের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকার সংশোধিত বাজেট পেশ না করায় আগের সরকারের দিয়ে যাওয়া বাজেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সূচকই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সুস্পষ্ট কোনো অর্থনৈতিক ইশতেহারও তৈরি করেনি।

তিনি বলেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে প্রত্যক্ষ করে মনোযোগ দেওয়া দরকার হলেও অন্তর্বর্তী সরকার আগের মতোই পরোখ করে নজর দিচ্ছে। আমরা বিস্মিত হয়েছি এটা দেখে যে কীভাবে অবিবেচনাপ্রসূতভাবে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানো হলো। কোনো দেশে সরকার যদি কার্যকরভাবে কর আদায় করতে চায় তাহলে তাকে ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ করের দিকে নজর দিতে হবে। কিন্তু প্রত্যক্ষ কর আদায়ের কোনো পরিকল্পনা দেখছি না। বিষয়টি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক সুরক্ষার প্রতি নজর বাড়ানোর আহ্বান জানান দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির হার ধীর হয়ে পড়ছে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। আবার কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়ে গেছে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, আমরা দেখেছি একই গ্রুপ ব্যাংক থেকে ঋণখেলাপি। একই গ্রুপ আবার করখেলাপি। ওই গ্রুপেই নানাভাবে টাকা পাচার করছে। এই আন্তঃসংযোগটা একদম নতুন। আমরা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের আধিপত্য দেখেছি, বড় ব্যবসায়ীদের দেখেছি রাষ্ট্র দখল করতে। যারা নানাভাবে সুবিধা আদায় করেছে, নীতিমালায় প্রভাব বিস্তার করেছে। একই সময়ে তারা বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের লিডারশিপও দখল করে নিয়েছিল। যখনই কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তখনই তারা বাধা দিয়েছে।

তিনি বলেন, পরপর তিনটি অসম্ভব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউশনগুলোকে (গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান) ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো রকমের জবাবদিহিতা বা জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা দেখা যায়নি। গত দেড় দশক ধরে রাজনৈতিক অর্থনীতির সমস্যাগুলো দেখছি। তবে এটা গত ৫ দশকের অধিক সময় ধরেই ছিল। দেড় দশকে সমস্যাগুলো অনেক জটিল হয়েছে, অনেক গভীর হয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, সরকারের প্রত্যেক কর্মকর্তার মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাব রয়েছে। কেননা তাদেরকে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যার কারণে তারা এসব কাজ করতে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তো অস্থায়ী সরকার। তাদের কাছ থেকে খুব বেশি এক্সপেক্ট করতে পারি না। কিন্তু কিছু পরিবর্তনের সূচনা আমরা আশা করতে পারি না। গত সরকারের সময় অর্থ লুণ্ঠনের চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রতিষ্ঠানের, এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। কোনো কিছু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নয়, উপরের আদেশে হয়। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পুনরুদ্ধার করতে হবে। কিন্তু পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় সরকারের খুব শক্তিশালী অবস্থান দেখছি না।

জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, বিগত সরকারের চৌর্যভিত্তিক প্রকল্প ছিল, মানুষের কল্যাণে কাজ হয়নি। পাচার টাকা ফেরত আনলে শাস্তি কম দেওয়া হবে এমন কিছু করা যায়। সঠিক স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা না বলায় বর্তমান সরকারের কাজে গতি নেই।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, আমলা ও ব্যবসায়ীরা দুর্নীতি করলে তাদের শাস্তির আওতায় আনার মতো শক্তি কী সরকারের আছে? আর তা করতে হলে কী করা দরকার তা নিয়ে কাজ করতে হবে। যেসব দেশ পাচারের টাকা ফিরিয়ে এনেছে তাদের পলিসিগুলো আমাদের অনুসরণ করতে হবে।

সিপিডির ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ৭টি মেগা প্রজেক্ট রিভিউ করতে গিয়ে দেখা গেছে, ১৮ হাজার টাকার বাজেট ১৮ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। এসব প্রজেক্ট ঋণের টাকায় করা হয়েছে। এসবের ঋণের চাপ আমাদের ও আগামী প্রজন্মের ওপর পড়েছে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন চ্যানেলে এসব টাকা পাচার হয়েছে। সেগুলো কীভাবে ফেরত আনা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। বিদেশের যেসব টাকা দেশে ঢুকেছিল তা ফেরত নেওয়া হয়েছে সেই আলোকে আমরাও ফেরত আনতে পারব।

Share

আরো খবর


সর্বাধিক পঠিত