Friday, 27 June, 2025
Logo
বিজ্ঞাপন
যাবতীয় রড, সিমেন্ট, ইট, বালি ও কনা পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় করা হয় ।। যোগাযোগ- মেসার্স হোসেন ব্রাদার্স/ জাকের ট্রেডার্স।। সোবান মঞ্জিল, বসুর হাট রোড, সিনেমা হলের পাশে, দাগনভুইয়া, ফেনী। প্রোপ্রাইটর জাকের হোসেন আলমগীর ০১৭১১-৯৬২৯২৫।। ০১৮৭১-৯৩০০০৮ মেসার্স কে আহাম্মদ এন্ড সন্স! পরিবেশক,বি এম, ডেল্টা ও ইউনি এল পি গ্যাস! যোগাযোগ- বসুরহাট রোড, সিনেমা হলের সামনে, দাগনভুইয়া, ফেনী- ০১৭১১-৩০৪৮৭৩, ০১৮৩৯-৩৯৭১৩০! দাগনভুইয়া ফিজিওথেরাপী সেন্টার, একটি আধুনিক বাত, ব্যথা, প্যারালাইসিস ও মুখ বাঁকা চিকিৎসা কেন্দ্র। ঠিকানা- সোবহান মঞ্জিল, বসুর হাট রোড। (সাবেক ঝর্না সিনেমা হলের পাশে)। দাগনভুইয়া, ফেনী। 01818-019684, 01721-910110

ইউরোপীয় বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা ও সভ্যতার মর্মান্তিক পরিহাস

বাবুল আকতার, ইতালি

প্রকাশিত: / বার পড়া হয়েছে


ছবি- সংগৃহীত

গত এক বছর ইতালির মাটিতে থাকার সময় ইউরোপের শহর-গ্রামের রাস্তায়, মাঠে আর গলিতে এক গভীর কষ্টদায়ক সত্য দেখেছি—এখানকার বয়স্ক নাগরিকদের নির্মম একাকিত্ব আর প্রায় নির্বাসিত জীবনের মর্মান্তিক চিত্র। এই অভিজ্ঞতা আমাকে বার্ধক্য, সমাজব্যবস্থা আর মানুষের সম্পর্কের দার্শনিক স্তরগুলো নিয়ে গভীর ভাবতে বাধ্য করেছে। আমার এই লেখা মূলত ইউরোপের বৃদ্ধদের একাকিত্বের মর্মস্পর্শী ছবি আর বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক ব্যবস্থার গভীর বন্ধনের মধ্যে তুলনামূলক দ্বন্দ্বের এক দার্শনিক চেষ্টা। এটি শুধু দুটি ভৌগোলিক এলাকার জীবনযাপনের পার্থক্য নয়, বরং মানুষের সংযোগ আর সম্পর্কের মৌলিক মূল্যবোধের এক গভীর বৈপরীত্যের দর্পন।

ইউরোপের প্রবীণ নাগরিক:
একাকিত্বের মর্মভেদী আহাজারি। ইউরোপে বার্ধক্য প্রায়ই নিঃসঙ্গতার প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে। এখানকার বয়স্কদের জীবন প্রাণহীন তবু শারীরিকভাবে সক্রিয়—যেন দেহের খাঁচায় এক মৃতপ্রায় আত্মার নীরব বাস। উন্নত অর্থনীতি, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা আর ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের তীব্র ধারণার আড়ালে মানুষের সম্পর্কের উষ্ণতা বরফ হয়ে গেছে।  

ইতালির গলিতে হাঁটা, রোমানিয়ার গ্রামীণ জীবন দেখা—প্রায় সব জায়গায় একই করুণ দৃশ্য: বয়স্ক হাতগুলো অসম্ভব যত্নে বাড়ির আঙিনায় নানা রকম সাজানো ফুলের গাছ লাগায়। এই ফুলগুলো দেখতে প্রাণবন্ত, সুন্দর, কিন্তু এর পিছনে লুকিয়ে আছে এক মর্মান্তিক সত্য:  
"যে হাতে ফুলের ডালে পানি পড়ে, সেই হাতেই কত পানি ঝরে—অদৃশ্য, অনুক্ত অশ্রুধারায়। ফুলের রঙ যত উজ্জ্বল, তাদের নিজ জীবনের রঙতুলি ততই ম্লান। ফুলের পাপড়ি যত নরম, তাদের হৃদয়ে জমে থাকা যন্ত্রণা ততই ক ঠিন।"

এই বৃদ্ধরা ফুলের সাথে কথা বলেন, কারণ মানুষের সাথে কথা বলার কোনো আগ্রহী শ্রোতা নেই। ফুলের কুঁড়ি ফোটার দিকে তাকিয়ে থাকেন, কারণ নাতি-পুত্রের মুখে হাসি ফোটার দৃশ্য আজ শুধু দূরের স্মৃতি। ফুলের গন্ধে ঘর ভরাতে চান, কারণ সন্তান-নাতিদের দেহের সুগন্ধ স্মৃতি থেকে মিলিয়ে গেছে। এই ফুলগুলোই তাদের একমাত্র নীরব সাথী, একমাত্র সান্ত্বনা, জীবনের একমাত্র ভরসা। কিন্তু এক প্রশ্ন থেকেই যায়: ফুলের সৌন্দর্য কি আত্মার শূন্যতা ভরতে পারে? রঙিন পাপড়ির আড়ালে কি লুকিয়ে আছে নাতি- নাতনির কপালে চুমুর উষ্ণ স্পর্শ?  

ইউরোপে সন্তানরা নিজেদের জীবনে এতই ব্যস্ত যে বাবা-মায়ের দেখাশোনায় সময় দেওয়া খুবই বিরল। সপ্তাহে একটিমাত্র ফোনকল বা বছরে একবার দেখা—এটাই যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। "কেমন আছ?"—এই সহজ প্রশ্নের উত্তরে "ভালো আছি" বলা ছাড়া উপায় নেই, কারণ আসল কষ্টের কথা শোনার ধৈর্য বা ইচ্ছা কারো নেই। এই সমাজের রীতিবদ্ধ স্বাতন্ত্র্য আর ব্যক্তিস্বাধীনতা মানুষের মধ্যে এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে, যেখানে সম্পর্কগুলো শুধু আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ। বৃদ্ধরা অনুভব করেন, তাদের অস্তিত্ব যেন পেনশন নম্বর বা ব্যাংকে জমা কিছু ইউরোর মধ্যে আটকা পড়েছে। এটি শুধু ব্যক্তিগত দুর্ভোগ নয়, এটি এক বিশাল সামাজিক ট্র্যাজেডি, যেখানে মানুষের সংযোগের মৌলিকতা লোপ পেয়েছে।

বাংলাদেশের পারিবারিক সমাজব্যবস্থা:
সহানুভূতির জীবন্ত স্তম্ভ এর পুরোপুরি উল্টো চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশের পারিবারিক সমাজব্যবস্থায়, যেখানে পরিবার শুধু থাকার জায়গা নয়, বরং এক প্রাণচঞ্চল, শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া সামাজিক সত্তা। এখানে প্রতিটি সদস্য পরস্পরের দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নেয়, এমনকি নীরব রাগের আড়ালেও বজায় থাকে এক আন্তরিক সম্পর্কের সেতু। এখানে বাবা-মা কখনো 'অবসরপ্রাপ্ত' হন না; তারা পরিবারে সবসময় এক স্নেহময় ছায়ার মতো থাকেন।  

বাংলাদেশের পরিবারে বয়স্ক বাবা-মা একা ঘুমান না; ছোট নাতিরা মাঝে মধ্যেই দাদুর গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ছেলে কাজে ব্যস্ত, তবু বাড়ি ফিরেই বয়স্ক মা-বাবার "কেমন আছো?" জিজ্ঞাসা করাও এক ধরনের পারিবারিক স্নেহ, দায়বদ্ধতা ও যত্নআত্তির চিরন্তন  চর্চা।  

এখানে সম্পর্ক শুধু রক্তের বাঁধনে আবদ্ধ নয়, দৈনন্দিন কথা, স্পর্শ, অপেক্ষা আর অভ্যাসের সুতোয় বোনা। মাটির ঘরে, টিনের ছাউনির নিচে, ঝড়-বৃষ্টিতে—এই পরিবারের ভিত নড়ে না, কারণ এখানে বয়স্ক মা-বাবা বোঝা নন, তারা ইতিহাস, অভিজ্ঞতা আর স্নেহের প্রাণকেন্দ্র। তাদের সুখ-দুঃখে পরিবারের অন্য সদস্যরা শারীরিকভাবে অংশ নেয়, আর মানসিকভাবে সবসময় পাশে থাকে।  

যেখানে ইউরোপে বৃদ্ধদের সপ্তাহান্তে একটিমাত্র ফোনকল জোটে, আর বাংলাদেশের মাটির ঘরে মায়ের একটু কাশি শুনলেই—  
পাশের ঘর থেকে ছেলেমেয়েরা বিছানা ছুঁড়ে ছুটে আসে।  
‘মা, ওষুধ খেয়েছো?’— এই জিজ্ঞাসাটা কখনো শুধু কথা নয়;  

একটা হাত ধরে রাখে, একটু কপাল ছুঁয়ে দেখে,  
আর চোখে চোখ রেখেই সমস্ত অসুখ টের পায়।  
স্পর্শের এই ভাষা কোনো বইয়ে লেখা নেই,  
এ তো রক্তের স্রোতে মিশে থাকা মমতার অদৃশ্য বর্ণমালা। এই পারিবারিক কাঠামো নিখুঁত নয়, সেখানে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, মাঝে মাঝে অবহেলা আছে, তবু সম্পর্কের বাঁধন এখনো পুরোপুরি ছিঁড়ে যায়নি। বাংলাদেশে বয়স্কদের বয়স বাড়ার মানে একাকিত্ব নয়; বরং সন্তানের আশ্রয়ে তাদের অভিজ্ঞতা নতুন রূপ পায়। বার্ধক্য এখানে তুচ্ছতা নয়—এক সম্মানের আসন, যেখানে বসে থাকা মানুষটি বলেন: "আমার জীবন শেষ হয়নি—এখন আমি শুধু পরিবারের ছায়া।"

বৈপরীত্যের মূল কারণ:
দার্শনিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এই দুটি সমাজে বার্ধক্যজীবনের বৈপরীত্যের গভীরে আছে মৌলিক দার্শনিক ও সামাজিক পার্থক্য:  

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বনাম সমষ্টিবাদ: 
ইউরোপীয় সমাজ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে চূড়ান্ত গুরুত্ব দেয়, যেখানে প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা আর স্বকীয়তাই প্রধান। এর ফলেই পারিবারিক বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার প্রবণতা দেখা যায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সমাজ সমষ্টিবাদী, যেখানে পরিবারের ঐক্য আর পরস্পরের নির্ভরতা মৌলিক মূল্যবোধ। এখানে মানুষ পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।  

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর সম্পর্কের মূল্য:

ইউরোপে অর্থনৈতিক উন্নতি আর যান্ত্রিক জীবনযাত্রা ব্যক্তিগত ব্যস্ততা বাড়িয়েছে, যার ফলে সম্পর্কে সময় আর আবেগ দেওয়ার সুযোগ কমে গেছে। বাংলাদেশে আর্থিক স্বাচ্ছল্য অপেক্ষাকৃত কম হলেও মানুষের সম্পর্কের মূল্যবোধ অত্যন্ত শক্তিশালী, যা দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামোকেও ছাড়িয়ে যায়।  

সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ:
বাঙালি সংস্কৃতিতে বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা আর যত্ন এক গভীর ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ। 'বাবা-মা' শুধু জন্মদাতা নন, তারা 'মুরব্বি' আর 'অভিভাবক', যাদের সম্মান আর সেবা করা সন্তানের অবশ্য কর্তব্য। ইউরোপে এই ধরনের রীতিবদ্ধ দায়বদ্ধতা এখন অনেকটাই শিথিল বা আদৌ নেই।

  চলবে....

লেখক, গবেষক ও প্রবাসী। 

Share

আরো খবর


সর্বাধিক পঠিত